নিরাপদ মাতৃত্বের নামে সিজারিয়ান ব্যবসা! ** প্রাইভেট হাসপাতালে অরাজক পরিস্থিতি


এক বছরে দেশের কিছু প্রাইভেট হাসপাতালে সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২১ জন প্রসূতি। তাঁদের মধ্যে এক লাখ ১৭ হাজার ১৬৪ জনের সিজারিয়ান করে সন্তান বের করতে হয়েছে। আর মাত্র ৪৭ হাজার ৮৬৮ জনের হয়েছে নরমাল ডেলিভারি। ২০১৩ সালের সরকারি তথ্যে এমন চিত্র উঠে এসেছে। অর্থাৎ তখন সিজারিয়ানের হার ৭০ শতাংশ থাকলেও চলতি বছর এ হার প্রায় ৮০ শতাংশে উঠে গেছে বলে জানান প্রসূতিসেবা বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশির ভাগ প্রাইভেট হাসপাতালের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতালগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনো প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর এক শ্রেণির চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। নিরুপায় হয়ে প্রসূতি ও তাঁর স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ্য সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেয়। আর সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকার খেলা।


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম মনিটর করার ব্যবস্থা সব সময় আছে। তবে যে হারে কথায় কথায় প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সিজারিয়ান হচ্ছে, তা এখন আমাদেরকেও ভাবিয়ে তুলছে। আর বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালের নীতিনৈতিকতা নিয়েও মানুষের মাঝে প্রশ্ন আছে। সব মিলিয়ে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। তাই আমরা এখন বিশেষজ্ঞ কমিটি করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণে নামব, যাতে নিরাপদ মাতৃত্বের নামে কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিক অনৈতিক ব্যবসা করতে না পারে।’

এদিকে সরকারি হাসপাতালে ভিন্ন চিত্র থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি হাসপাতালের এক শ্রেণির চিকিৎসক কিংবা দালাল নানাভাবে প্রসূতিকে নিরাপদ মাতৃত্বের নামে বাইরের প্রাইভেট ক্লিনিকে ভাগিয়ে নেয়। তবে এখনো সরকারি হাসপাতালে বেশির ভাগই হয় নরমাল ডেলিভারি। সর্বশেষ সরকারি স্বাস্থ্য বুলেটিনের তথ্য অনুসারে, সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতাল ও প্রসবকেন্দ্রে ২০১৩ সালের এক হিসাবে তিন লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৫ জনের প্রসব হয়। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয় দুই লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৪ জনের আর পেট কেটে সন্তান প্রসব করতে হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ১৮ জনের। অন্য ভাবে হয়েছে আট হাজার ৪৮৩ জনের। এ হিসাব গত বছরের সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিনের।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধু গুরুতর কোনো জটিলতার মুখে জরুরি প্রয়োজনে সিজারিয়ানের (পেট কেটে সন্তান বের করা) কথা থাকলেও এক শ্রেণির চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেবল টাকার লোভে অপ্রয়োজনেও রোগীদের সিজারিয়ানের ফাঁদে ফেলে থাকেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণত বেছে নেওয়া হয় তুলনামূলক সচ্ছল পরিবারের প্রসূতিদের। প্রসবকালীন জটিলতা ছাড়াও ব্যথা এড়ানো কিংবা শারীরিক কিছু ভুল ধারণাও ঢুকিয়ে দেওয়া হয় প্রসূতি নারী ও তাঁর স্বামীর মনে। ফলে তাঁরা সিজারিয়ানের প্রতি আকৃষ্ট হন। অবশ্য কিছু নারী স্বেচ্ছায় কিছুটা ফ্যাশন হিসেবেও নিজ থেকে সিজারিয়ানের সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান ওই বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকার একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী সুলতানা পারভীন প্রথমবার মা হবেন। মীরপুরের একজন পরিচিত গাইনি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর বা গর্ভের সন্তানের অস্বাভাবিক কোনো সমস্যা ছিল না। ফলে ওই চিকিৎসক সিদ্ধান্ত দেন, সুলতানার নরমাল ডেলিভারি হবে। একপর্যায়ে স্বামীর ইচ্ছায় ভালো হাসপাতালে ডেলিভারির জন্য বেছে নেওয়া হয় ধানমণ্ডি এলাকার অপেক্ষাকৃত একটি অভিজাত প্রাইভেট হাসপাতাল। নির্ধারিত সময়ের তিন দিন আগে ওই হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। নামকরা একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ দেখেন তাঁকে। তাঁর পরামর্শে পরিবর্তন হয় আগের সিদ্ধান্ত। নরমাল ডেলিভারির পরিবর্তে সিজারিয়ানের মাধ্যমে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন সুলতানা। সব মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় ৯০ হাজার টাকা। সুলতানা বলেন, ‘আগের ডাক্তার নরমাল ডেলিভারির কথা বললেও ধানমণ্ডির হাসপাতালে আসার পর এখানকার ডাক্তার এমন কিছু সম্ভাব্য সমস্যার কথা বলেন, যাতে আমি ও আমার স্বজনরা সবাই ভয় পেয়ে আর নরমাল ডেলিভারির ঝুঁকি নিইনি। নরমাল ডেলিভারির চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা গেছে এখানে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কোনো প্রসূতিকে নিয়ে আসা হলেই বেশির ভাগ চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই প্রসূতিকে সিজারিয়ানের জন্য বিভিন্ন কৌশলে বাধ্য করে। কারণ নরমাল ডেলিভারির চেয়ে সিজারিয়ানে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অনেক বেশি টাকা পান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরও এতে ব্যবসা বেশি। কারণ বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়, ওষুধ বেশি লাগে, অপারেশন থেকে শুরু করে

মন্তব্যসমূহ